পড়ায় মন বসে না? জেনে নিন ৫টি সহজ কিন্তু অব্যর্থ উপায়


বইটা সামনে খোলা, কিন্তু মন কোথায়? ফেসবুকের নিউজফিড, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, কিংবা কালকের খেলার চিন্তা—হাজারো ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, শুধু বইয়ের পাতায় চোখ থাকছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, কিন্তু পড়া আর এগোচ্ছে না।

যদি আপনার গল্পটা ঠিক এমন হয়, তবে একদম চিন্তা করবেন না। এই সমস্যাটা শুধু আপনার একার নয়, বাংলাদেশের লাখো শিক্ষার্থীর এটাই প্রতিদিনের বাস্তবতা।

খুশির খবর হলো, পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়াটা কোনো জন্মগত প্রতিভা নয়, এটি একটি দক্ষতা। আর যেকোনো দক্ষতার মতোই, সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে একে শাণিত করা যায়। আজ আমি আপনাদের সাথে এমন ৫টি বাস্তবসম্মত উপায় নিয়ে কথা বলব, যা আপনার পড়ার অভ্যাসকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে।

১. ২৫ মিনিটের ম্যাজিক: পমোডোরো টেকনিকের জাদু

ভাবুন তো, আপনাকে ম্যারাথন দৌড়াতে না বলে যদি ছোট ছোট স্প্রিন্টে দৌড়াতে বলা হয়, কোনটা বেশি সহজ মনে হবে? অবশ্যই ছোট স্প্রিন্ট! পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এই কৌশলটি দারুণ কার্যকর। একেই বলে “পমোডোরো টেকনিক”।

কীভাবে করবেন?

  • একটি টাইমার বা ফোনের স্টপওয়াচে ২৫ মিনিটের জন্য সময় ঠিক করুন।

  • এই ২৫ মিনিট ফোন, মানুষ, বা অন্য সব চিন্তা থেকে দূরে থেকে पूरी মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

  • সময় শেষ হলে ৫ মিনিটের একটি ছোট্ট বিরতি নিন। এই সময়টায় একটু হাঁটাহাঁটি করুন, পানি খান বা চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিন।

  • এভাবে ৪ বার (অর্থাৎ ৪টি পমোডোরো সেশন) শেষ করার পর ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের একটি লম্বা বিরতি নিন।

কেন এটা কাজ করে?
আমাদের মস্তিষ্ক একটানা মনোযোগ দিতে পারে না। ছোট ছোট বিরতি মস্তিষ্ককে সতেজ করে তোলে এবং নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করতে সাহায্য করে।

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: বিরতির ৫ মিনিটে কিন্তু ফেসবুকে ঢুঁ মারা বা ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করা চলবে না! এতে মস্তিষ্ক বিশ্রাম পাওয়ার বদলে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

২. পড়ার ‘মুড’ তৈরি করুন: নিজের একটা পড়ার জায়গা বানান

আমাদের মন পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়। একটা গোছানো, শান্ত পরিবেশ মনোযোগ বাড়াতে অবিশ্বাস্যভাবে সাহায্য করে।

  • নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করুন: প্রতিদিন পড়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট টেবিল-চেয়ার ব্যবহার করুন। বিছানায় বসে পড়বেন না, কারণ বিছানা আমাদের মস্তিষ্ককে ঘুমের সংকেত দেয়।

  • টেবিল রাখুন পরিষ্কার: আপনার পড়ার টেবিলে শুধু সেই মুহূর্তের প্রয়োজনীয় বই-খাতা আর কলম রাখুন। একগাদা বই আর খাতার স্তূপ মনোযোগ নষ্ট করে।

  • আলো-বাতাসের ব্যবস্থা: যেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে, সেখানে বসুন। দিনের বেলা জানালার পাশে বসা সবচেয়ে ভালো।

  • বিরক্তিকর জিনিস দূরে রাখুন: পড়ার সময় আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো আপনার মোবাইল ফোন। ফোনটিকে হয় অন্য ঘরে চার্জে দিয়ে আসুন, অথবা সাইলেন্ট করে চোখের আড়াল করে রাখুন। পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিন যে, এই সময়টা আপনার পড়ার জন্য নির্ধারিত।

৩. মস্তিষ্ককে দিন সঠিক খাবার: পেটে যা, মাথায় তা

গাড়িতে যেমন তেল ছাড়া চলে না, আমাদের মস্তিষ্কও তেমন সঠিক খাবার ছাড়া ঠিকঠাক কাজ করে না। কিছু খাবার আছে যা সরাসরি আপনার স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

  • মাছ ও ডিম: রুই, কাতলা, ইলিশ মাছের মতো দেশি মাছে থাকা ওমেগা-৩ এবং ডিমের কোলিন মস্তিষ্কের জন্য দারুণ উপকারী।

  • বাদাম: প্রতিদিন অল্প পরিমাণে চিনাবাদাম, কাজুবাদাম বা আখরোট খাওয়ার অভ্যাস করুন।

  • মৌসুমি ফল ও শাক-সবজি: দেশি মৌসুমি ফল (যেমন: পেয়ারা, আমলকী, কলা) এবং সবুজ শাক-সবজি আপনার মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে।

  • পানি পান করুন: পড়ার মাঝে মাঝে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। শরীর পানিশূন্য বা ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে মনোযোগ কমে যায়।

কী এড়িয়ে চলবেন?
অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয় এবং সিঙ্গারা, সমুচা বা অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার পড়ার আগে এড়িয়ে চলুন। এগুলো আপনাকে অলস ও ঘুম ঘুম ভাব এনে দেবে।

৪. শরীরটাকে একটু নাড়াচাড়া আর ঘুমকে দিন গুরুত্ব

শরীর আর মন একে অপরের সাথে જોડાયેલ। শরীর যদি সতেজ না থাকে, তবে মনেও তার প্রভাব পড়বে।

  • হালকা ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা যেকোনো ধরনের হালকা ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়ে, যা মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

  • পর্যাপ্ত ঘুম: রাত জেগে পড়ার অভ্যাস লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম অপরিহার্য। ঘুমের মধ্যেই আমাদের মস্তিষ্ক সারাদিনের পড়াগুলো গুছিয়ে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত করে। তাই ঘুমকে অবহেলা করবেন না।

৫. ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করুন আর নিজেকে বাহবা দিন

পুরো বই একদিনে শেষ করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। এই বিশাল লক্ষ্যই আমাদের মনে পড়ার প্রতি অনীহা তৈরি করে। এর বদলে, লক্ষ্যকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিন।

  • সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বানান: “আজ অনেক পড়ব” – এমন লক্ষ্য ঠিক না করে বলুন, “আজ রাত ৯টার মধ্যে এই অধ্যায়ের প্রথম ৫ পৃষ্ঠা পড়ব এবং ২টি অঙ্ক করব।”

  • বাস্তবসম্মত হোন: নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী লক্ষ্য ঠিক করুন যা পূরণ করা সম্ভব।

  • সাফল্য উদযাপন করুন: যখন একটি ছোট লক্ষ্য পূরণ হবে, তখন নিজেকে ছোট একটা ট্রিট দিন। যেমন: এক কাপ চা খাওয়া, পছন্দের একটা গান শোনা বা ৫ মিনিটের জন্য বন্ধুর সাথে কথা বলা। এই ছোট পুরস্কারগুলো আপনাকে পরবর্তী লক্ষ্যের জন্য অনুপ্রেরণা দেবে।

শেষ কথা

মনে রাখবেন, অভ্যাস একদিনে তৈরি হয় না। প্রথম দিনেই হয়তো আপনি সবকিছু নিখুঁতভাবে করতে পারবেন না। কিন্তু হতাশ হবেন না। ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যান।

শুরুটা হোক আজ থেকেই। যেকোনো একটি উপায় বেছে নিন এবং সেটিকে আপনার রুটিনে शामिल করুন। ধীরে ধীরে দেখবেন, পড়াশোনা আর আপনার কাছে বিরক্তিকর বা কঠিন কোনো কাজ মনে হচ্ছে না, বরং এটি আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

আপনার স্বপ্ন আপনার হাতেই। শুভকামনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top